
মানব বিবর্তনের ইতিহাসে আমাদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় হলো নিয়ান্ডারথাল’রা। ১৮৫৬ সালে জার্মানির ডুসেলডফ নামক শহরের কাছে ডুসেল নদীর পার্শ্ববর্তী নিয়ান্ডারের ফেল্ডহোফার নামক গুহায় এদের ফসিল সর্বপ্রথম আবিষ্কার হয়। এরপর বিজ্ঞানীরা এদের আলাদা প্রজাতি হিসেবে স্থান দেন। এদের সাথে হোমো সেপিয়েন্স এর অনেক মিল থাকলেও কিছু দিক দিয়ে আলাদা ছিল এরা। আধুনিক মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের মধ্যকার যৌনমিলন, বাচ্চা উৎপাদন, জিন প্রবাহ অন্তত ৭ বছর দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এছাড়াও যেসব বৈশিষ্ট্য আধুনিক মানুষ নিয়ান্ডারথালদের নিকট থেকে পেয়েছে তা আমাদের জিনের সাথে মিলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম এবং ত্বকের পিগমেন্টেশন কে প্রভাবিত করে, অতীতে এসব জিন সাহায্য করেছিলো আফ্রিকার বাহিরের জলবায়ুর (ইউরোপের ঠান্ডা জলবায়ু উল্লেখযোগ্য) সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। তবে প্রকৃতির নিয়মে একসময় এরাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিলুপ্তির কারণ হিসেবে প্রতিযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আদি আধুনিক মানুষের সাথে সংকর-প্রজননের মাধ্যমে অনুর্বর বাচ্চার সংখ্যাবৃদ্ধি এবং ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন’কে সহায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে সম্প্রতি আরো একটি কারণ খুঁযে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে Rh ফ্যাক্টরের একটি বিরল ধরন পাওয়া গেছে, যা আধুনিক মানুষের মধ্যে খুবই দুর্লভ। এই বিরল Rh ফ্যাক্টর নবজাতকদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, বিশেষ করে যদি মায়ের এবং শিশুর Rh ফ্যাক্টর ভিন্ন হয়। আর এই Rh ফ্যাক্টরই হতে পারে তাদের বিলুপ্তির আরেকটি কারণ। মূলত এই Rh ফ্যাক্টর মায়ের শরীর শিশুর রক্তকণার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে, যা হেমোলাইটিক ডিজিজ অফ দ্য নিউবর্ন (Hemolytic Disease of the Newborn) সৃষ্টি করতে পারে এবং শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
মানুষের রক্তের ধরন মূলত ABO এবং Rh সিস্টেম দ্বারা নির্ধারিত হয়। ABO সিস্টেমে রক্তের ধরন হতে পারে A, B, AB এবং O, এবং Rh ফ্যাক্টর হতে পারে পজিটিভ বা নেগেটিভ। নিয়ান্ডারথালদের রক্তের ধরন সম্পর্কে আগে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে নতুন গবেষণায় কিছু নির্দিষ্ট নমুনা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা তাদের রক্তের ধরন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। যেমনঃ সাইবেরিয়ার দেনিসোভা গুহা থেকে পাওয়া ১,০০,০০০ বছর পুরনো এক নিয়ান্ডারথাল নারীর রক্তের ধরন ছিল A। চাগিরস্কায়া গুহার প্রায় ৪৮,০০০ বছর পুরনো আরেক নিয়ান্ডারথাল নারীর রক্তের ধরনও ছিল A। ক্রোয়েশিয়ার ভিন্ডিজা গুহা থেকে পাওয়া ৬৪,০০০ বছর পুরনো এক নিয়ান্ডারথাল নারীর রক্তের ধরন ছিল B। এরকম নানা ধরণের বৈচিত্র্য ছিল তাদের মাঝে।
নিয়ান্ডারথালরা ছোট এবং বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে বাস করত। এতে করে তাদের মধ্যে উচ্চমাত্রার ইনব্রিডিং (Inbreeding) হয়, যার ফলে জেনেটিক বৈচিত্র্য কমে যায়। এতে করে বিরল Rh ফ্যাক্টরের নেতিবাচক প্রভাব আরও বেশি অনুভূত হয়, যা তাদের প্রজনন সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করেছিল বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। ফ্রান্সের আইক্স-মার্সেই ইউনিভার্সিটির গবেষকরা তিনটি নিয়ান্ডারথাল ও একটি ডেনিসোভানের জিনোম বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল পান। ভবিষ্যতে এভাবেই হয়তো মানব বিবর্তনের আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবো আমরা। সেই পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা যাক।
তথ্যসূত্রঃ
1. Live Science – Neanderthals’ blood type may help explain their demise
2. Archaeology.org – Neanderthal Blood Types and Extinction